রবিবার ০৫ মে ২০২৪
Online Edition

তাইওয়ানের পানিসীমায় চীনের মিসাইল নিক্ষেপ 

সংগ্রাম ডেস্ক: তাইওয়ানকে ঘিরে ‘কৌশলগত মহড়া’ শুরু করেছে চীন। চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভি জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে তাইওয়ানের চারপাশের সাগরে সামরিক মহড়া শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এই মহড়া চলবে আগামী রোববার পর্যন্ত। চায়না ডেইলি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের একদিনের মাথায় আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ এই রুটটিতে শক্তি প্রদর্শন শুরু করেছে বেইজিং। আল জাজিরা, এএফপি, রয়টার্স

সিসিটিভি জানিয়েছে, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত পিপলস লিবারেশন আর্মির একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চীনের গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে ‘পুনর্মিলন অপারেশন’ এর জন্যই এই পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া সিসিটিভি-র এ সংক্রান্ত পোস্টের সঙ্গে তাইওয়ানের একটি মানচিত্র জুড়ে দেয়া হয়েছে।

তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, চীনের এই সামরিক মহড়া তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাইপে কোনও সংঘাত চায় না। তবে যেকোনও সংঘাতের জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছে।

এদিকে চীনের সঙ্গে বিরোধ না বাড়ানোর নীতি অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

চীনা সামরিক বিশেষজ্ঞ সং ঝংপিংকে উদ্ধৃত করে গ্লোবাল টাইমস বলছে, ‘যে অপারেশনাল পরিকল্পনাগুলো বর্তমানে মহড়া করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে এগুলো সরাসরি যুদ্ধ অভিযানে রূপান্তরিত হবে।’

এর আগে ন্যান্সি পেলোসির সফরের পর চীনের ২৭টি যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে তাইপে। বুধবার তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফে এমন অভিযোগ করা হয়।

তাইওয়ানের পানিসীমায় চীনের মিসাইল নিক্ষেপ : তাইওয়ানের পানিসীমার ভেতর মিসাইল নিক্ষেপ করেছে চীন। ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে সফর করার পর স্বশাসিত দেশটিকে ঘিরে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে চীন। এরই অংশ হিসেবে তাইওয়ানের পানিসীমার ভেতর মিসাইল ছুঁড়েছে তারা।

চীনের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা থেকে সামরিক মহড়া শুরু হয়। আগামী রোববার ভোর ৪টা পর্যন্ত এ মহড়া চলবে। 

চীনের ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের সিনিয়র কর্ণেল শি ই একটি বিবৃতিতে বলেছেন, চীনে অবস্থানরত রকেট ফোর্সের সেনাদের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোঁড়া বিভিন্ন ধরনের ব্যালাস্টিক মিসাইল তাইওয়ানের ইস্টার্ন উপকূলের নির্ধারিত পানিসীমার ভেতর আঘাত হানে।  তিনি আরও জানান, সবগুলো মিসাইল নির্ধারিত স্থানে সফলভাবে গিয়ে আঘাত হেনেছে।

এদিকে মিসাইল ছোঁড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে তারা বলেছে, তাইওয়ানের মূল ভূখ-ের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে কয়েকটি ডংফেং মিসাইল ছুঁড়েছে চীন। এদিকে বৃহস্পতিবার মিসাইল ছোঁড়ার মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের পর প্রথমবারের মতো তাইওয়ানের পানিসীমায় মিসাইল ছুঁড়েছে চীন। সে বছর লি তে-হুই ফের তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তাইওয়ান নিয়ে চীনের আচরণ দায়িত্বজ্ঞানহীন: যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর চীনের সামরিক মহড়া চালানোর ঘোষণায় ক্ষোভ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় সময় গত বুধবার এ ঘটনাকে চীনের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ বলে উল্লেখ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। পেলোসি তাইওয়ান ছেড়ে যাওয়ার পর তাইওয়ানের চারপাশের পানিসীমায় বৃহস্পতিবার থেকে বড় পরিসরে সামরিক মহড়া চালানোর ঘোষণা দিয়েছে চীন।

সামরিক মহড়া চলাকালে ওই এলাকায় বিদেশি জাহাজ ও বিমান প্রবেশ না করাতে বলেছে বেইজিং। বিশ্ববাণিজ্যে তাইওয়ান ও এর আশপাশের পানিসীমা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গত বুধবার ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জেক সুলিভান বলেন, ‘আমরা মনে করি, চীন এখানে যা করছে, তা তাদের দায়িত্বশীল আচরণ নয়।’

সুলিভান বলেন, ‘যখন কোনো সামরিক বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা, তাজা গোলার মহড়া, আকাশে যুদ্ধবিমান ওড়ানো এবং সাগরে জাহাজ নিয়ে টহল দেয়ার মতো কর্মকা-ে যুক্ত থাকে, তখন কিছু বিষয় বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।’ তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা কমাতে বেইজিংকে আহ্বান জানিয়েছেন সুলিভান।সুলিভান বলেন, ‘আমাদের আশা, চীন দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং উত্তেজনা এড়াবে যেন আকাশপথ ও সাগরপথে হিসাব-নিকাশে ভুল না হয়ে যায়।’

পেলোসি তাইওয়ান ছেড়ে যাওয়ার পর বুধবার রাতে অঞ্চলটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ২৭টি চীনা যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলে (এডিআইজেড) প্রবেশ করেছিল।

চীন ও তাইওয়ান : কার কেমন সামরিক সক্ষমতা : ইউক্রেন যুদ্ধ আর বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির মন্দাবস্থার মধ্যে এক সপ্তাহ ধরে আলোচনায় তাইওয়ান। মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির বিতর্কিত তাইওয়ান সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। পেলোসির তাইওয়ান সফরের আগে থেকে ওয়াশিংটনকে নানা হুমকি দিচ্ছিল বেইজিং। বুধবার পেলোসির তাইওয়ান সফর শেষ হওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার তাইওয়ানের চারপাশ ঘিরে এযাবৎকালে সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। এর মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ শিগগির এ সংঘাত শুরুর ব্যাপারে সতর্ক করছেন। কিন্তু সামরিক শক্তিতে কার সক্ষমতা কত? ২০২২ সালে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের (জিএফপি) র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৪২টি দেশের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সক্ষমতার তালিকায় চীনের অবস্থান ৩ নম্বরে। আর তাইওয়ানের অবস্থান ২১ নম্বরে।

এদিকে যুক্তরাজ্যের দ্য এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তাইওয়ানের সঙ্গে তুলনায় চীনের সামরিক ক্ষমতা অনেক বেশি। দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চীনের সামরিক সক্ষমতা এত বেশি যে ভবিষ্যতে যেকোনো সংঘাত শুরু হলে এর বহুবিধ সুবিধা পাবে বেইজিং। তাইওয়ানের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা হবে মুশকিল।

পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ নামে পরিচিত চীনের সামরিক বাহিনীতে এখন সক্রিয় সেনার সংখ্যা ২০ লাখ। অপর দিকে তাইওয়ানের সেনা বড়জোর ১ লাখ ৬৯ হাজারের মতো। অপর দিকে বেইজিংয়ের পদাতিক বাহিনীর সেনাসংখ্যা ৯ লাখ ৬৫ হাজার। তাইওয়ানের পদাতিক বাহিনীতে সদস্য আছেন ৯৪ হাজার। তাইওয়ানের জন্য বড় হুমকি চীনের নৌবাহিনী। চীনের নৌবাহিনীর সদস্য ২ লাখ ৬০ হাজার। এদিকে তাইওয়ানের নৌবাহিনীর সদস্যসংখ্যা মোটে ৪০ হাজার। সমুদ্রে তাইওয়ানের নৌবাহিনীর মোট ২৬টি জাহাজ রয়েছে। বিপরীতে চীনের নৌবাহিনীর জাহাজের সংখ্যা ৮৬টি। এ ছাড়া তাইওয়ান হলো স্বশাসিত একটি দ্বীপ। কোনো ধরনের সামরিক সংঘাত শুরু হলে সবচেয়ে বেশি লড়াই হবে নৌপথে। সেই তুলনায় তাইওয়ানের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে আছে চীনা নৌবাহিনী।

এ ছাড়া সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে তাইওয়ান। চীনের রয়েছে পাঁচ হাজার ট্যাংক। অপর দিকে তাইওয়ানের কাছে ট্যাংক আছে ৬৫০টি। এদিকে ৩ হাজার ২০০টি যুদ্ধ ও সামরিক বিমান নিয়ে আকাশপথে তাইওয়ানকে টেক্কা দেবে বেইজিং। অপর দিকে তাইওয়ানের কাছে যুদ্ধ ও সামরিক বিমান আছে মাত্র পাঁচ শতাধিক। সামরিক শক্তিতে চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা তাইওয়ান সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে তাইওয়ান। গত জানুয়ারিতে দেশটির পার্লামেন্ট সামরিক খাতে বরাদ্দ এক ধাক্কায় দ্বিগুণ করেছে। ২০২১ সালে তাইওয়ানের সামরিক খাতে বরাদ্দ যেখানে ছিল ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে ২০২২ সালের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।

তাইওয়ানের সরকার বলেছে, আরও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও নৌবাহিনীর জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজের কথা ভেবেই সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। চীন যে তাইওয়ানে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও সেই শঙ্কা ব্যক্ত করেছে। সিআইএর পরিচালক বিল বার্নস গত মাসে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে তাইওয়ানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে আরও অগ্রসর হতে পারে চীন। তিনি বলেছেন, ‘এটা হওয়ার ঝুঁকি এখন অনেক বেশি বলেই আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। তাইওয়ানকে বেইজিংয়ের কবজায় নেয়ার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অবিচল অবস্থানকে আমি ছোট করতে চাচ্ছি না।’

এদিকে পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে ক্ষুব্ধ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ বিপজ্জনক বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মদদ পেয়ে তাইওয়ানের এই ‘সাহস’ তৈরি হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ